
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতাকর্মী দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থেমে নেই দোসরদের কার্যক্রম। বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এখনো দোসরমুক্ত হয়নি। এ নিয়ে ক্রিকেটে চলছে ভরাডুবির মৌসুম। একের পর এক ম্যাচ পরাজয়। চারদিকে যখন সমালোচনার ঝড়, তখন ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন, অন্য পরিচালকরা খুঁজছেন আইকনিক প্লেয়ার। আর বিসিবির সভাপতির এসব দেখার সময় কোথায়?
সম্প্রতি শ্রীলংকা সফরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ইতোমধ্যে টেস্টে আত্মসমর্পণ ও তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ পরাজয় বরণ করেছেন টাইগাররা। প্রথম ওয়ানডেতে ৭৭ রানে পরাজয়। ১০০ থেকে ১০৫—মাত্র ৫ রানের ব্যবধানে ৭ উইকেট হারায় মেহেদী হাসান মিরাজের দল। তৃতীয় ম্যাচে পরাজয়ের ব্যবধানটা আরও বড়, ৯৯ রানের। আবার টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে শান্তর পদত্যাগ। এসব নিয়ে ক্রিকেটবোদ্ধারা চরম ক্ষুব্ধ।
জাতীয় দলের এমন ভরাডুবিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও সেদিকে কান নেই বিসিবির কর্মকর্তাদের। তারা চলছেন নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যানকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি যেন কথা বলার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বিসিবির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেন সাবেক ক্রিকেটার, অধিনায়ক ও প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদকে। কিন্তু বছর না পেরোতেই দুর্নীতির অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই— দুর্নীতি, টাকা ট্রান্সফার ছাড়াও সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল— হাথুরুসিংহকে বিদায়। কিন্তু শুরুতে হাথুরুসিংহেকে বিদায় করা তার চরম ভুল ছিল। এটি মেনে নিতে পারেননি গত ১৫ বছর ধরে বিসিবিতে দুর্দান্ত পারফর্ম করা কর্মকর্তারা।
আর দায়িত্ব পেয়েই যেন আবেগী হয়ে পড়েন সাবেক প্রধান নির্বাচক। ভুল পথে যাত্রা শুরু করেন। বলা যায় সময়টা দুর্ভাগ্যের ছিল ফারুক আহমেদের। সে জন্য সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ঝড়ে ভেঙে পড়া ঘর ঠিক না করে বাইরের কাজে হাত দেন। অথচ তার উচিত ছিল— ১৫ বছরের ঘুণে ধরা ঘর সংস্কার করেই চেয়ারে বসা। এরপর মাঠের কাজে নজর দেওয়া। ক্রিকেট দলের ভগ্নদশার দিকেও নজর ছিল না তার। তবে জাতীয় দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে দ্রুত বিদায় করে ভালোই করেছিলেন তিনি। যদিও আমি সভাপতির সিদ্ধান্তে একমত। কিন্তু এতে সায় ছিল না দোসরদের। আর তারই খেসারত দিতে হয়েছে সভাপতিকে।
আমি পেছনে তাকাতে চাই না, আবার না তাকিয়েও বা উপায় নেই; সবকিছুই যে পেছনে টেনে নিয়ে যায়। সে কারণে বারবার সভাপতি রদবদল। কারণ একটাই— সবকিছু পেছন থেকেই কলকাঠি নাড়ছেন দোসররা। তাদের কলকাঠিতে পতন হয়েছে প্রধান উইকেটের (ফারুক আহমেদের)।
দায়িত্ব নিলেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তিনি সভাপতির পদে বসতেই মনে পড়ে যায় সেই সময়ের রেডিও ও টেলিভিশনে ধারাভাষ্য দেওয়া ধারাভাষ্যকার মঞ্জুর হাসান মিন্টু, খোদা বক্স মৃধা আর চৌধুরী জাফরুল্লাহ শরাফতের কথা।
ক্রিকেটার বুলবুল মাঠে নামতেই তাদের কণ্ঠে ভেসে উঠত একটি কথা— বরাবরের মতোই চার মেরে খাতা খুললেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। এখনো সেই ধ্বনি কানে ভেসে আসে। আবারও তিনি টি-টোয়েন্টি খেলতে মাঠে নেমেছেন। এবার ধারাভাষ্যে শোনা যায় সিন্ডিকেটের শব্দ, খেলার কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় না— শুধু গড়গড় শব্দ শোনা যায়।
নতুন সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর ঘর ঠিক না করে তিনিও সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদের মতো কাজ শুরু করে দিয়েছেন। একইভাবে পাপন গংদের দলে রেখেই টি-টোয়েন্টি খেলা শুরু করে দিয়েছেন। যার মধ্যে কয়েকজন বাদে সেই ১৫ বছর ধরে যারা খেলে আসছেন, তারাই সভাপতির দলীয় সঙ্গী। কিন্তু এটা কোন ধরনের টি-টোয়েন্টি, তা বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার বয়স সবে এক মাস হয়েছে। এর মধ্যেই তিন উপদেষ্টাকে অবৈতনিক নিয়োগ দিয়ে সমালোচিত হন তিনি। কিন্তু ক্রিকেট উপদেষ্টাকে নিয়ে ক্রিকেটের উন্নয়নে সভাপতি দেশব্যাপী চোষে বেড়াচ্ছেন। আর এ নিয়ে শুরু হয়েছে ক্রিকেট উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে ঘরে-বাইরে সমালোচনা। সে কারণে সভাপতির ক্রিকেট উপদেষ্টা আবিদ হোসাইন সামী এ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
যে সংগ্রাম আর লড়াই করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন, নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশকে স্বৈরাচার মুক্ত করেছেন, সেই দুর্নীতিবাজ আর দোসরদের বিষদাঁত ভেঙে দিতে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে যে নিরন্তর সংস্কারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সংস্কারের ছাপ ছিটেফোঁটাও পড়েনি বিসিবিতে।
এটা যেন ছকে বাঁধা একটা সিনেমার গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ক্রিকেট দলের ভগ্নদশা ঠিক না করে দেশব্যাপী টেস্ট ক্রিকেটের ২৫ বছরপূর্তি পালন। অথচ ২৫ বছরে ২৫টা টেস্ট ম্যাচ জেতা হয়নি। এটিকে সামনে না এনে জেলাপর্যায়ে উন্নয়নে তিনি কাজ শুরু করেছেন। আম্পায়ারিংয়ের মান বাড়াতে ব্যস্ত। আমি বলছি না— এসব কাজ ঠিক হচ্ছে না। আগে তো সংস্কার করা উচিত ছিল, নয় কি?
দায়িত্ব নেওয়ার পরই শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্টে ভরাডুবিতে সভাপতি যা বললেন, তা যেন আকাশ থেকে ভেঙেপড়া বজ্রপাত। প্রথম টেস্টে ড্র করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় টেস্টে শ্রীলংকার কাছে ইনিংস ও ৭৮ রানের ব্যবধানে হেরেছেন টাইগাররা। সেই সঙ্গে নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। খবরটা বিসিবির নতুন সভাপতির কাছে পৌঁছায়। বিসিবিপ্রধান বলেন, মাত্রই খবর পেলাম আমরা হেরে গেছি। যেহেতু আমি এই ম্যাচটি দেখিনি, তাই প্রতিক্রিয়া দিতে পারছি না। আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমি একটা ব্যাপার পরিষ্কার করতে চাই— আমি বোর্ডের সভাপতি, কিন্তু বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা আমার কাজ না। স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন চলে আসে— এটি কার কাজ?
যাই হোক, টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো শান্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে বিসিবিপ্রধান বলেন, এসবের জন্য ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগ আছে, কোচ, ম্যানেজার, নির্বাচকরা আছেন। তাদের কাজ এটি। তারা যদি কখনো মনে করেন, আমাকে কাজে লাগাবেন অবশ্যই আমি সাহায্য করব।
ওপেনার লিটন দাস। তাকে ছাড়া একাদশ নয়—যেন এমন পণ। এ নিয়ে কেউ কেউ প্রস্তাবও দিয়েছেন— তার মূর্তি বানিয়ে বিসিবির সামনে রাখার। অথচ চোখ থাকতে অন্ধ নির্বাচক-কর্মকর্তারা— সব মিলিয়ে শেষ ৮ ইনিংসে দুই অংকের ঘর ছুঁতে পারেননি লিটন। মোট রান করেছেন ১৩; এর মধ্যে চার ম্যাচে শূন্য। শেষ ১৪ ম্যাচের আগে একমাত্র ফিফটি করেছেন পুনেতে ভারতের বিপক্ষে ২০২৩ সালে। এরপর থেকেই একের পর এক ব্যর্থতার পরও তাকে মাঠে নামানো হয়েছে এবং হচ্ছে।
আবার যে মুহূর্তে তিনি অফফর্মে, সেই সময় তাকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করা হলো। অথচ তার একাদশেই জায়গা পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু তাকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো। আবার আজ অফফর্মে থেকেই শ্রীলংকার বিপক্ষে মাঠে নামছেন লিটন। মানে—পুতুল পুতুল খেলা, যেমন খুশি সাজো; ভেরি শেম, বিষয়টি হাস্যকর বৈকি।
আর সাবেক নির্বাচক নান্নু-বাশার থেকে শুরু করে বর্তমান লিপু-রাজ্জাকরা বারবার সেই লিটনকে সুযোগ দিতে গিয়ে বলির পাঁঠা হয়েছেন ওপেনার ইমরুল কায়েস-সোহান-অঙ্কনরা। ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে তাদের। লিটনকে যেভাবে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেভাবে কি ইমরুল কায়েস-সোহান-অঙ্কনকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে—এটি দেখার দায়িত্ব কার, এটি কার কাজ?
ইমরুল বিপিএলে কাপ জিতেছে। সোহান রংপুর রাইডার্সের অধিনায়ক হিসাবে গ্লোবাল সুপার লিগে কাপ জিতেছে এবং গত ডিপিএলেও দাপট দেখিয়ে খেলেছে। কিন্তু লিটনের সাফল্য কোথায়? এসব দেখার দায়িত্ব কার?
সাবেক ও বর্তমান নির্বাচকদের চক্ষুশূলে পরিণতি শুধু ইমরুল -সোহান নয়; তাদের যাঁতাকলে পড়ে পিষ্ঠ হয়েছেন মুশকিক, রিয়াদ, সাইফুদ্দিন, মোসাদ্দেক, জিয়া, রাকিবুল, অঙ্গন, শহিদুল, নাসির, রুবেল, আকবর আলিরা। তাদের ক্যারিয়ার আজ ধ্বংসের মুখে। অথচ আকবর আলি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক। সেদিন ভারতের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে লড়াই করে ৪৩ রানের উইনিং ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়। অথচ বিসিএল ওয়ানডেতে উত্তরাঞ্চলের নেতৃত্ব দিয়েও আকবর আলি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এমন একটি খেলোয়াড় নির্বাচকদের বলির শিকার। শুধু তাই নয়, সেদিনের বিস্ময়কর সাফল্যের অন্যতম নায়ক বাঁহাতি স্পিনার রাকিবুল— কোথাও নেই। কিন্তু আজকের এই দুর্দিনে আকবর আলি-রাকিবুলদের কষ্টের সীমা নেই। তাদের চেয়ে চেয়ে দেখতে হয় বাংলাদেশ দলের পরিণতি। অথচ অনূর্ধ্ব-১৯ ভারত বিশ্বকাপ দলের রানার্সআপ অধিনায়ক ছিলেন জয়সওয়াল। আজ তিনি বিশ্ব স্বীকৃত ব্যাটার। তবু বিসিবিতে দেখার কেউ নেই।
আর সাইফউদ্দিন ১৩ মাসের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শ্রীলংকায় গেলেন টি-টোয়েন্টি খেলতে। যে কিনা ২০২৪ সালে বিপিএলে ৯ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে বিশ্বকাপের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই সিরিজে ৮ উইকেট পেয়েছিলেন, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে জায়গা হয়নি। এটা কি বৈষম্য না প্রতিহিংসা—কোনটি, বুঝে আসে না?
আবার পঞ্চপাণ্ডবদের বয়সের দোহাই দিয়ে রীতিমতো বিতাড়িত করা হয়েছে। গত বছর বেশ জমে উঠে ক্রিকেটপাড়ায় নাটক আর ওটিটি সিরিজ। একবার তামিম-সাকিব তো, আরেকবার মুশফিক-রিয়াদ। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই আত্মসমর্পণ করে অবসরের ঘোষণা দেন। অথচ এই পঞ্চপাণ্ডবের বিদায়ে যে ভূমিকা পালন করেছেন বিসিবির নির্বাচক আর কর্মকর্তারা, যদি তাদের রিপ্লেসমেন্ট একজনকেও দাঁড় করাতে পারতেন, তবেই ক্রিকেটপ্রেমীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। বরং তারা ম্যাচ হারার পর বলেছেন– লিটনের ফর্মে ফেরা প্রাপ্তি, এতদিন পর আমরা একজন ভালো ওপেনিং জুটি পেয়েছি, আমরা একজন অলরাউন্ডার পেয়েছি। আমাদের আরও ভালো করতে হবে। এই প্রাপ্তি পেতে পেতে টানা ৭টি ওয়ানডে ম্যাচ হেরে বসে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব দেখার দায়িত্ব কার ‘মাননীয় সভাপতি’?
আপনি একজন ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে— ১৯৯৪ ফুটবল বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ বয়স ছিল ক্যামেরুনের রজার মিলারের। ৪২ বছর বয়সে খেলে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকাপে তিনি সবচেয়ে বয়স্ক গোলদাতা হিসেবে নিজের রেকর্ড ভাঙেন। শুধু এটা কেন, বুড়ো বয়সেও পাকিস্তানের শোয়েব মালিক আর মোহাম্মদ হাফিজ জাতীয় দলে খেলেছেন। আপনার নির্বাচকরা কজন খেলোয়াড় রির্জাভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিলেন তামিম-মুশফিক-রিয়াদের বিপক্ষে। তাদের বিকল্প তৈরি না করে ঘুরেফিরে সেই সৌম্য, শান্ত আর লিটন। অথচ আজ আপনারা বলছেন— আমাদের আইকনিক প্লেয়ার নেই। এসব দেখার দায়িত্ব কার?
শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে ইমন ও তাওহীদ হৃদয় ফিফটি করলেও খেলেছেন টেস্ট। এরা টি-টোয়েন্টি খেলতে নামলে খেলে ওয়ানডে, আর ওয়ানডে খেলতে নামলে খেলে টেস্ট। এটা দলে নিয়মে পরিণত হয়েছে। এরা কোনোমতে ফিফটি করতে পারলেই পরের ম্যাচে দলে চান্স পাওয়া নিশ্চিত করে ফেলে। আর এরা কেউ দলের স্বার্থে খেলে না। আর নেই দলের মধ্যেও একতা, একে অপরের প্রতি নেই সম্মানবোধ। শুধুমাত্র নিজেকে দলে টিকিয়ে রাখতে যা করা প্রয়োজন, এরা তাই করে। আজ যেখানে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড ওয়ানডেতে নিয়মিতই ৩০০ থেকে ৩৫০ রান করে চলেছে, সেখানে আমরা ২৫০ রানের গণ্ডি পেরোতে পারি না।
অথচ তামিম-সাকিব-মুশফিক-রিয়াদ এখনো দলের জন্য নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। তামিম-সাকিবকে এখনো দলে হিসাব করা যেত, কিন্তু বিসিবির স্বেচ্ছাচারী মনোভাবে তাদের ক্যারিয়ার শেষ।
তামিম-মুশফিক-রিয়াদ অবসরে গেলেও সাকিব এখনো অবসর নেননি; তবে তিনি দেশান্তরী। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দেশে না থেকেও তিনি হুকুমের আসামি। বিসিবি কি পারত না সাকিবকে দেশে এনে জামিনে মুক্ত করে খেলাতে। অবশ্যই সম্ভব ছিল। কারণ দেশ সংস্কারের মাঝেও আওয়ামী লীগের অনেক রাঘববোয়াল দেশে ঘাপটি মেরে বসে আছেন—জনগণ জানে, শুধু ক্ষমতাসীন দেশচালকরা জানেন না।
সাবেক বিসিবিপ্রধান ফারুক আহমেদ যে পথে হেঁটেছিলেন, ঠিক একই পথে হাঁটছেন বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সাকিবের বিষয়টি তিনিও এড়িয়ে গেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি যদি হুকুমের আসামি হয়ে দেশে থাকতে পারে, তবে সাকিব কেন নয়?
শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে পরাজয়ের পর দলের অধিনায়ক মিরাজ যা বললেন, তা অবিশ্বাস্য— তারা তরুণ, শিখছে, তাদের আরও সুযোগ দিতে হবে। এই যে শেখা, আবার বারবার সুযোগ দেওয়া, তাতে আমি অবাক হচ্ছি না। কারণ এখানে মিরাজের কোনো দোষ নেই; দোষ হচ্ছে বিসিবির নির্বাচক আর ম্যানেজমেন্টের। তাদের কারণে আজ এ পরিণতি। অথচ চোখ মেলে তাকান—পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা বিপিএল খেলে জাতীয় দলে চান্স পায়। আর আমাদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা— কোথাও কেউ নেই। তাই সাকিব ছাড়া আর কেউ নেই বিশ্বমঞ্চে খেলার।
এ কথা আপনার কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি— এটাই বাস্তবতা। রেকর্ড তাই বলে—আজ যে খেলোয়াড় ফিফটি করেছে, কাল সে দুই অংকের ঘরে যেতে পারে না। নির্ঘাত বাজিতে হেরে যাবেন আপনি। কিন্তু সাকিবের রেকর্ড সে কথা বলে না। শুধু তাই নয়, আফগানিস্তানের জাতীয় দলের ১৫ খেলোয়াড়ের মধ্যে ১০ জনই আইপিএল খেলেন এবং তাদের ছাড়া একাদশ হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের কয়জন খেলোয়াড় আইপিএলে খেলেন? গতবার ছিল শূন্যের কোটায়।
বিসিবির নির্বাচক-কর্মকর্তাদের সাকিবের প্রতি যে বিমাতাসুলভ আচরণ তা খুবই দুঃখজনক। যে বৈষম্য আচরণ শুরু হয়েছে বিসিবিতে, তাতে আরেকটা সাকিব আগামী ১০০ বছরেও পাওয়া যাবে না।
ছাত্র-জনতা আন্দোলন করে দুর্নীতিবাজ সরকারকে বিদায় করেছে। তার বিনিময় ছাত্রদের জীবন দিতে হয়েছে। এর প্রতিদান কি এই— কোনো সংস্কার না করেই দোসরদের নিয়েই দেশব্যাপী টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলবেন? বিগত সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে এগিয়ে যাবেন? এটাই কি আপনার কাজ?