জাতীয়: শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হবে, ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন ভাঙচুর হবে- সুধা সদনও রক্ষা পাবে না, আওয়ামী লীগের অফিসগুলো তছনছ হবে- তালা খোলার লোক পাওয়া যাবে না। এসব কথা বহুবার বলেছি। আওয়ামী লীগের লোকজন রাগ করেছেন কিন্তু কেন জানি আমাকে ইলিয়াস আলীর মতো গুম করেনি কিংবা জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে ধরে যেভাবে সরাসরি পায়ের ওপর বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা হতো ওভাবে আমাকে পঙ্গু করে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের তাণ্ডব জানের ওপর না পড়লেও আমার মন-মানসিকতা ও চিন্তাকে বিপর্যস্ত করেছে। আর আমার মাল-সামান ব্যবসায়-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা বলতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে হবে।
আওয়ামী লীগকে নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে আসছি ২০০৯ সাল থেকে। আওয়ামী লীগের অর্জন নিয়ে যেমন বলেছি তদ্রƒপ যেসব দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারের কারণে শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হলো এবং সারা দেশের কোটি কোটি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী যেভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তার অশনিসঙ্কেত আমি ২০০৯-১০ সালেই দেখতে পেয়েছিলাম। ফলে আওয়ামী অবিচার-অনাচার ও দুরাচার নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে সভা-সমিতি, সেমিনারে, টিভি টকশো কিংবা লেখনীতে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলাম তা ভাবলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেও আমার হাঁটুতে কাঁপুনি শুরু হয়। অথচ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি ছিলাম অকুতোভয়-বেপরোয়া একজন মানুষ।
আমি ভেবে পাই না, কোন সাহসে আমি জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে নিয়ে লিখেছিলাম-কাদের মোল্লার উস্তাভাজি-বৈকালিক গান এবং চিরকুট। মীর কাশেমের মন খারাপ নিয়ে কেন আমার নিবন্ধ লিখতে ইচ্ছে হয়েছিল। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে নিয়ে সাত-আটটি উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নয়া দিগন্ত পত্রিকায়। সংসদ সদস্য থাকাকালীন বেগম জিয়া-শহীদ জিয়া ও তারেক রহমানের জীবনের ইতিবাচক বিষয়াদি নিয়ে নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়েও বহুবার লিখেছি। গুম হওয়া ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ যারাই পুলিশ-র্যাব-ডিজিএফআই দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। জননেতা মাহমুদুর রহমান মান্না যখন ধরা পড়লেন তখন তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করেছি।
আজকের দিনে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঝে মধ্যে ভাবি, ওসব কেন করলাম! আওয়ামী লীগ তো আমাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী কোনোকালে আমাকে অপমান, অপদস্ত তো দূরের কথা- টেলিফোন করে একটি উহ্ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। আওয়ামী হাইব্রিড আমলা-কামলারা নিজেদের নির্বুদ্ধিতা দ্বারা আমার গাড়ি-বাড়ি ভেঙেছে এই আশায় যে তারা যদি আমার ওপর জুলুম করেন তবে শেখ হাসিনা হয়তো খুশি হবেন। কিন্তু আমি যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি এবং তা যখন মিডিয়ায় এসেছে তখন আমলা-কামলারা উল্টো বিপদে পড়েছেন। এসব কাণ্ড কেন ঘটেছে, কিভাবে ঘটেছে তা আমি আজও বুঝতে পারি না।
ব্যক্তিজীবনে আমি চুপচাপ এবং লাজুক প্রকৃতির মানুষ। আমার সাহস-শক্তি ও বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জীবনের অসংখ্য ভুল, নির্বুদ্ধিতা, ব্যর্থতা এবং পদে পদে ঠকে যাওয়ার যে খতিয়ান আমার রয়েছে তার সাথে লেখক-বক্তা হিসেবে যে পরিচিতি জুটেছে তা কেন জানি মেলে না। জীবনের এই বিপরীতমুখী বাস্তবতা নিয়ে চলতে ফিরতে আমি যে কি বিপত্তিতে পড়ি তা শুনলে আপনারা হেসে গড়াগড়ি খাবেন। আমার বুদ্ধিশুদ্ধি-সাহস নিয়ে যখন পরিবারের সামনে কেউ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তখন আমার স্ত্রী মুখ টিপে হাসে এবং ছেলেমেয়েদের অবাক-অভিব্যক্তি আমাকে যারপরনাই রাগান্বিত করে তোলে। তারপর বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের পারিবারিক জীবনের দুরবস্থার কথা স্মরণ করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি।
আমি ভেবে পাই না, আমার নিজের জীবন যেখানে অসংখ্য ভুলে ভরা, সেখানে আমি কেন অন্যের ভুল ধরতে যাই। তা ছাড়া আমার সাথে কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির যেমন রাগ-বিরাগ নেই তদ্রƒপ আহামরি দহরম-মহরমও নেই। আড্ডাবাজি, এ-বাড়ি ও-বাড়িতে ঘোরাঘুরি, মন্ত্রী-এমপি বা অন্য কোনো পদ-পদবির লালসা আগেও ছিল না এখনো নেই। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি কিন্তু কেন পেয়েছি তা যেমন মাথায় ঢোকে না তদ্রƒপ যা হারিয়েছি তা কেন হারালাম এমন প্রশ্নও মাথায় আসে না। সুতরাং আমার মতো অথর্ব মানুষের অনুর্বর মস্তিষ্কে হঠাৎ করে এমন সব প্রশ্নের উদ্রেক হয় কিংবা আমার লাজুক চরিত্র ভেদ করে আমার জড়তাসম্পন্ন ঠোঁট কিভাবে হঠাৎ সচল হয়ে খই ফোটাতে শুরু করে, ভেবে তার কূলকিনারা পাই না।
আমার জীবনের উল্লিখিত পরস্পরবিরোধী মনোভাব-কার্যক্রম ও চিন্তা-চেতনার সাতকাহন আপনাদের কাছে বর্ণনা করার কারণ হলো, হালআমলে আমার পুরোনো রোগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল অবধি সাধ্যমতো চেষ্টা তদবির করেছি, অর্থ ব্যয় করেছি এবং বিএনপি সরকার ও এক-এগারোর সরকার কর্তৃক যে জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছি সেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতার মসনদে বসার মাত্র এক মাসের মাথায় যেভাবে আমার মুখ দিয়ে খই ফুটতে আরম্ভ করেছিল, তদ্রƒপ শেখ হাসিনার পতনের পর ড. ইউনূস সরকারের কর্মকাণ্ড দেখেও মুখ দিয়ে খই ফোটার অবস্থা দমন করতে পারছি না। অথচ শেখ হাসিনার পতন এবং ড. ইউনূসের ক্ষমতা লাভের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য গত ১৫ বছর ধরে কত কিছুই না করেছি।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ যেভাবে হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে যান ঠিক একইভাবে তারা মুহূর্তের মধ্যে নীরব ও নিস্তব্ধ হয়ে যান। কারো পক্ষ নেয়ার জন্য তারা যেমন কালক্ষেপণ করেন না, তদ্রƒপ কারো বিরোধিতা করার জন্যও তাদের কোনো উসিলা দরকার হয় না। এ দেশে সুন্নতে খতনার অনুষ্ঠানে মাইক বাজে, ভূরিভোজ হয় এবং মেয়েরা নেচে-গেয়ে তা উদযাপন করে। ১২ মাসে ১৩ পার্বণ এবং আনন্দ-বেদনা হাসি-কান্না যুদ্ধ-বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, মামলা-মোকদ্দমা এবং ব্যক্তিজীবনে ভ্রষ্টতার কিংবা পাপাচারে কোনো সীমা পরিসীমা দেখতে না পেয়ে গত শতাব্দীর অন্যতম পণ্ডিত শ্রী নিরদ চন্দ্র চৌধুরী বাঙালিকে আত্মঘাতী বলে অভিহিত করে বিখ্যাত একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন।
নিরদ চন্দ্র চৌধুরীর বর্ণনা মতে, আমি কি আত্মঘাতী বাঙালি নাকি অন্য কিছু তা নিয়ে হয়তো অন্য একদিন বিস্তারিত আলোচনা করব। আজ শুধু শিরোনামের সাথে চলমান সময় এবং আমার জীবনের সাতকাহনের মধ্যে কী অন্তঃমিল রয়েছে তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে ইতি টানব। প্রাচীন সাহিত্য এবং দর্শনশাস্ত্রের যেসব অমূল্য গ্রন্থ পড়ার সুযোগ পেয়েছি সেখানে মানুষের অভ্যাস নিয়তি ভূখণ্ড এবং সময়ের মধ্যে যে অন্তঃমিল দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, একই মানুষ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে। শীতকালে যে প্রতিজ্ঞা করল বাকি জীবন সে সাধু সন্ন্যাসী হয়ে কাটাবে, ঠিক সেই লোকটি গ্রীষ্মকালে এসে কালবৈশেখীর তাণ্ডব দেখে সিদ্ধান্ত নিলো যে, জীবনের সফলতা বলতে যদি কিছু থাকে তা অবশ্যই দাবনীয় শক্তি অর্জন করা এবং কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার মধ্যেই কেবল সফলতা নিহিত।
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সেই দলের বড় বড় নেতার মুখে কত যে ভালো কথা শুনেছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিন্তু যখন তারা ক্ষমতা পেয়েছেন অমনি তাদের অতীতের সেসব ভালো কথা যখন কর্পূরের মতো উবে যেতে দেখেছি, তখন আর মুখ বন্ধ রাখতে পারিনি। অতীত ইতিহাস ঘেঁটে মানুষের জীবনে নিয়তির লীলাখেলা এবং জীবনের পরিণতির যে অঙ্ক কষতে শিখেছি তাতে মনে হয়েছে- ¯্রােতের অনুকূলে গা ভাসানোর চেয়ে প্রতিকূলে সাঁতার কাটা নিরাপদ ও সম্মানের। নিজের জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এবং মহাকালের অসংখ্য ঘটনার সমীকরণে বুঝতে পেরেছি, জীবন একটি অঙ্ক। এখানে সূত্রের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ যদি অঙ্কের সূত্র অনুসরণ না করে তবে যেমন ফলাফল মিলবে না- তদ্রƒপ জীবনের হিসাব মেলাতে হলে অঙ্ক জানতে হবে, সূত্র অনুসরণ করতে হবে এবং কাক্সিক্ষত ফল লাভের জন্য সূত্রমতে এগোতে হবে।
আমরা কমবেশি সবাই উল্লিখিত বিষয়াদি জানি কিন্তু নিয়তির পরিহাস, প্রায় সবাই একই ভুল করি। আইয়ুব খান যা করেছেন পরবর্তীতে ইয়াহিয়া, টিক্কা, জিয়াউল হক- একই কর্ম করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে ভুল করেছেন ঠিক একই ভুল করেছেন ইন্দিরা গান্ধী, বেনজীর ভুট্টো ও তার পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং শেখ হাসিনা। এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ড. ইউনূস। তিনি কি শেখ হাসিনার মতো একই ভুল করবেন, নাকি নিয়তির প্রতিশোধের যে ইতিবাচক পথ রয়েছে সেই পথ অনুসরণ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করবেন তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
সূত্র : নয়াদিগন্ত