সারাদেশ: দেশ রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরীরা দরবার হলে রক্তাক্ত। সাগর-রুনি বেডরুমে নিজেদের অবুঝ শিশুর সামনে রক্তাক্ত। গুম হওয়া ভাইবোনরা কেউ আয়নাঘরে, কেউ পুলিশ কাস্টডিতে, কেউবা হাসপাতালে রক্তাক্ত। ইলিয়াস আলীরা গহিন অরণ্যে, নির্জন খালে, স্রোতঃস্বিনী নদীর ধারে, অথবা সাগরের মোহনায় রক্তাক্ত। আলেম সমাজ শাপলা চত্বরে রক্তাক্ত। রক্তে লাল আমার বাড়ি, ঘর, উঠোন, রাজপথ, হাসপাতাল। আমার গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল, আমার নদী, আমার সাগর রক্তাক্ত। রক্তাক্ত আমি, আমরা, আমাদের সবাই। আর আমার বাংলাদেশ। আমি এবং আমরা আজ সেই রক্তাক্ত বাংলাদেশ থেকে বিচারের ‘দাবি নিয়ে এসেছি’। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। পিলখানায় রক্ত লেগে আছে। রাজপথে, হাসপাতালের বিছানায় রক্ত লেগে আছে। আমাদের সাদা ছাদে লাল রক্ত। ধানক্ষেতে, পুকুরের পানিতে, নদীর বহমান জলে, বন্ধ ঘরে, উন্মুক্ত আঙিনায়, বাড়ির ছাদেও। আমি যে স্পষ্ট লাল রক্তের দাগ এখনো দেখতে পাই। আপনি পান না? আমি আমার কলিজায়, আমার বোনের, বাবার, ভাইয়ের, ছাত্রছাত্রী, কৃষকের, তাঁতির, মজুরের, হিন্দুর, মুসলমানের, বৌদ্ধের, আমাদের সবার রক্ত দেখি। আমি ঘুমাতে পারি না। ক্লান্ত-শ্রান্ত, ঘুমন্ত সাগর-রুনির রক্ত দেখে কতদিন ঘুমাতে পারিনি। পিলখানায় আমার নিরপরাধ সেনা অফিসার ও সৈনিকের তাজা রক্তে আমি কতদিন অব্যক্ত থেকে দ্রোহে মরেছি। নারায়ণগঞ্জের কিশোর ত্বকী, শান্ত ছেলেটা। বাসা থেকে বের হয়ে আর মায়ের কাছে ফিরে আসেনি। বেশ কিছুদিন পর তার লাশ ভেসে ছিল শীতলক্ষ্যায়। সেও বিচার পায়নি। শাপলা চত্বরের ওই দৌড়ে পালানো লম্বা দাড়িওয়ালা মাদ্রাসার ছাত্রটির রক্ত কতদিন আমাকে বিবেক বোধের যন্ত্রণায় তাড়িয়েছে।
রাজপথে দৌড়ানো হিন্দু ছেলেটি, কী জানি তার নাম? বিশ্বজিৎ। ওহ! দর্জির দোকানে কাজ করে। কী যে বাঁচার আকুতি করছিল। কালো দেহটি লাল হয়ে গেছে। তবুও দৌড়াচ্ছে আর বলছে আমি হিন্দু, আমি মুসলমান নই, আমি শিবির নই। আপনার বুকের মধ্যে কোনো কাঁপন হয় না বুয়েটের আবরারের কথা মনে পড়লে। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নিথর দেহটা নিজের নিরাপদ ক্যাম্পাসে শুয়ে ছিল মুখ গম্ভীর করে, অভিমান করে। ওর কি জানি দোষ? ফেসবুকে কিছু লিখেছিল? তাই না? নিজের বন্ধুরা, নিজের বড় ভাইয়েরা সারা রাত মেরে রক্তাক্ত করেছে। আবরার ওদের কিছু বলেনি। বলেছে আমাকে, আপনাকে আর আমরা যারা বুদ্ধি বিক্রি করি তাদের। আমরা কী অসহায়ের মতো দেখতাম, আমার ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে, হলে ঘুমাতে গেলে, পরীক্ষা দিতে এলে প্রিয় ক্যাম্পাসে রক্তাক্ত। আমি এত রক্তের কী জবাব দিলাম? আপনাদের সিনহার কথা মনে আছে। কী নির্মমভাবে তাকে খুন করল একজন পুলিশের কর্মচারী। আপনাদের মনে আছে প্রদীপ পা দিয়ে সিনহার মুখ স্পর্শ করে দেখছিল, অফিসার সাহেব এখনো জীবিত কি না। এটা মৃত্যু! এত মৃত আত্মার সঙ্গে জীবিত মানুষের নির্মমতা। আমি সেদিন নীরব ছিলাম। ধুঁকে ধুঁকে মরেছি। আপনারা ঠিক ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে ভুলে গেছেন। ওকে ওর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, ওর সহপাঠীদের দিয়ে পুড়িয়েছিল। সাদা ছাদে কালো ধোঁয়ায় নুসরাত কী আকুতিটাই না করেছিল তার সহপাঠীদের কাছে, বাঁচার জন্য। আরও কত অগুনতি মৃত্যু আর রক্ত! আমি আর বিচার না চাওয়ার দায় নিতে পারব না। আমায় মুক্ত করুন।
এই সেদিন মিছিল করতে এসে রক্তাক্ত আমার মেয়েরা, আমার ছেলেরা, তাদেরই হলে, মলচত্বরে আর তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। আপনাদের ঠিক মনে পড়বে, বহুদিন মনে পড়বে বুক পেতে শুকনো ঘাস ভিজিয়েছে এই সেদিন, আমাদের রংপুরের সাঈদ। আর মুগ্ধ যে নিজের পানিতেই লাল করল রাজপথ। ওই ছেলেটা, কী সুন্দর, পবিত্র মুখখানা, পুলিশের গাড়ি থেকে ফেলে দিল রাজপথে। টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দিল ইয়ামিনকে, একটু একটু নড়াচড়া করছিল যার জীবন প্রদীপ। আচ্ছা, এখনো কি তার মা, বাবা, ভাই, বোন বা তার স্বজনদের কেউ কি আক্ষেপ করে বলে—ওহ! একটুখানি যদি হাসপাতালে নিত কেউ। হয়তো বেঁচে যেত, ইয়ামিন। পুলিশের সাঁজোয়া গাড়িটা রাজপথে ফেলে দেওয়া অর্ধমৃত অস্তিত্বটি সরিয়ে আবার চলল। রিয়াদ, ফারহান, আর তাহির—তারাও তো নির্মম হত্যার শিকার। নাম না জানা আরও কত রক্তাক্ত লাশ। এত লাশ আমি দেখিনি কখনো। শত শত লাশ। লাশের গন্ধ মর্গে, হাসপাতালে ও বাড়িতে। আমার ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ কেনা স্বাধীনতায়। শিশুদের কথা আপনাদের মনে আছে? চার বছরের আহাদ, সাড়ে ছয় বছরের রিয়ার কথা। ৩২ জনের নাম এসেছে, না জানি আরও কত শিশু রয়েছে। রাজার ক্ষমতা বোঝার আগেই পৃথিবী থেকে চলে গেছে অকালে। তাদের আত্মাগুলো, তাদের মায়েরা, বাবারা আমরা যারা বয়স্ক আছি, তাদের অভিশাপ দিচ্ছে না? এই তো ১৪ দিন আইসিইউতে থেকে ১ আগস্ট ঝালকাঠির সেলিম চলে গেলেন না ফেরার দেশে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজিদও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
এত রক্ত! আমি আর নিতে পারছি না। সব রক্তাক্ত। আমাদের দেহ, কলিজা, অন্তর রক্তাক্ত। আমি এই রক্তাক্ত বাংলাদেশে থেকে মুক্তি চাই। সব খুনিকে ধরিয়ে দিন। ওদের বিচার করুন। আমাকে ও আপনাকে এবং আমাদের সবাইকে রক্তাক্ত মঞ্চ থেকে মুক্ত করুন। মৃত আত্মাগুলো কাঁপছে। আমার বাড়িতে, আপনার বাড়িতে, আমাদের সবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা আমাদের ডাকছে। ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের হাতে হাত রেখে বলে—তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ? আমাদের খুনিদের বিচার হয়নি। হে বাংলাদেশিরা, আমি তোমাদের জন্য অকালে ঝরে গেলাম, তোমাদের স্বাধীনতার জন্য। কী তীব্রতায় বলেছিলাম, ‘বুকের মাঝে ভীষণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ গুলি আমি খেয়েছি তোমার জন্য, কিন্তু আমার আত্মা এখনো বন্দি। ও বিচার চায়। অধিকারের জন্য যেভাবে তারা আমাকে, আমাদের খুন করেছে তুমি তা দেখতে পাও না? খুনিদের ধরিয়ে দাও। ওদের পাশে থেকো না। ওদের বিচার করো আর আমাদের আত্মাকে মুক্ত করো। ওহ, তোমাদের মিডিয়া, সামাজিক জীবনের সব জায়গায় কি এখনো আমাদের হত্যাকারী স্বৈরাচারীরা রয়ে গেছে। নাকি তোমরা আবার সেই স্বৈরাচারীদের দোসরদের পরিবর্তনের বন্ধু বানিয়েছ? আমাদের খুনিদের বিচার হবে না? কবে হবে? আমি যে মুক্ত হতে পারছি না। ওদের বিচার হলে আমি, তুমি, আমরা বাংলাদেশিরা মুক্ত হব। আবার আসব কোন এক রাতে, গভীর রাতে তোমাকে জাগাতে, আমার হত্যাকারীদের বিচারের জন্য তোমাকে ঘুম থেকে ওঠাতে। জাগো। এমনভাবে জাগো আর কখনো যেন কোনো স্বৈরাচারী রাজা বাংলার মানুষ, ছাত্র-জনতা, বাড়ির শিশু, বয়স্ক মহিলা, ঘুমন্ত মানুষ, রাস্তার হকার, রিকশাওয়ালা, দরিদ্র পথচারী, শ্রমজীবী পোশাক শ্রমিক কাউকেই খুন করতে না পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সব খুনের সুষ্ঠু বিচার চাই। স্বৈরাচার নিপাত যাক, স্বাধীনতার বিজয় হোক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়